গরমে হাঁসফাঁস করছে সারা বাংলাদেশ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাট ধু ধু করছে। কাকপক্ষীরও দেখা নেই। এই তপ্ত সূর্য রশ্মির দাপটের সামনে সবাই বেশ ক্লান্ত। আর যাঁরা একান্তই কোনও উপায় না পেয়ে বেরচ্ছেন, তাঁদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে একাধিক সমস্যার।
ছবিঃ ১
এমন একটি সমস্যা হচ্ছে হিট স্ট্রোকে। তীব্র দাবদাহে অনেকেই হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। আর এই অসুখ কিন্তু মেডিক্যাল ইর্মার্জেন্সি। তাই সচেতন হওয়া ছাড়়া আমাদের হাতে আর কোনও গতি নেই।
এই অসুখের বিভিন্ন উপসর্গ, প্রতিরোধের বিভিন্ন উপায় জানবো আজকের ভিডিওতে ।
প্রথমে জেনেনি হিট স্ট্রোক কি ?
হিট স্ট্রোক হলো এমন একটি চিকিৎসাগত জরুরি অবস্থা যার ফলে শরীরের তাপমাত্রা 40 ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা ১০৪ ডিগ্রি ফেরেনহাইট বা তার ওপরে চলে যায় ।
যদি হিট স্ট্রোকের অবিলম্বে ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে এটা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রতঙ্গকে নষ্ট করে দিতে পারে এবং তা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
জলবায়ু সংক্রান্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে, হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
তাই দেরি না করে এই অসুখের লক্ষণ ও প্রতিরোধের কৌশল জেনে নেওয়া দরকার।
কেন হয়?
হিট স্ট্রোকের প্রধান কারণ হলো অনেকক্ষণ সূর্যের তীব্র রোদের সংস্পর্শে থাকা । আমাদের শরীরে সূর্যের প্রখর তাপ সরাসরি লাগার পর, শরীর তার স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে লোমকূপের মাধ্যমে ঘাম বের করে শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, কিন্তু বাহিরের তাপমাত্রা আতিরিক্ত হওয়ার কারণে এই পরিস্থিতিতে শরীর তার সেই স্বাভাবিক কাজকর্ম বজায় রাখতে পারে না। যারফলে শরীরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বারতে থাকে যা 40 ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা ১০৪ ডিগ্রি ফেরেনহাইট উপরে চলে যায় । আর এই অবস্তা বেশিক্ষণ থাকলে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়।
যাদের হিট স্ট্রোক হওয়ার প্রবণ বেশি –
সব বয়সিরাই এই অসুখে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যাদের বেশি থাকে তারা হলো –
- বয়ষ্ক ব্যক্তি। বার্ধকয , বিভিন্ন রোগ ও রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা কম্থাকায় এনাদের শরীর গরম আবহাওয়ার সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে না।
- শিশুরা রোদে দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা — এমনকি বিদ্যালয়ে প্রাত্যহিক সমাবেশ ও শরীরচর্চার (পিটি) সময় তারা হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে।
- খেলোয়াড় বা রোদে পরিশ্রমকারী। যেমন ভ্যান-রিকশা-ঠেলাগাড়ির চালক, হকার, কারখানার শ্রমিক ও কৃষক।
- যাঁরা বাইরের পরিবেশে কাজকর্ম করেন।
- স্থুলকায় ব্যক্তি বা মোটা মানুষ
- মানসিক ভাবে অসুস্থ ব্যক্তি।
- যারা মদ্যপান করেন।
- যারা জল অথবা পানীয় কম গ্রহণ করেন, এর ফলে ডিহাইড্রেশন বা শরীরে জলের ঘাটতি দেখা দেয়।
কী কী লক্ষণ থাকে?
হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তি শরীরে যে উপসর্গগুলি হতে পারে টা হচ্ছে –
- কোন ওরকম ঘাম দেওয়া ছাড়াই ত্বক লাল, গরম ও শুষ্ক হয়ে ওঠে।
- শরীরের তাপমাত্রা খুবই বেড়ে যায়। এই সময় তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যেতে পারে ।
- শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস ।
- খিটখিটে ভাব, অদ্ভুত ব্যবহার শুরু করতে পারে, তাঁর খিঁচুনিও হতে পারে ।
- বমিভাব বা বমি হওয়া।
- মাথাব্যথা।
- ক্লান্তি।
- হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি বা ট্যাকিকার্ডিয়ার
- মাথা ঘোরা বা সবকিছু গুলিয়ে যাওয়া।
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
কেউ হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিক ভাবে আমাদের করণীয় কি ?
- যদি দেখেন যে কোনও ব্যক্তির হিট স্ট্রোক হয়েছে, তাহলে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তাকে কোনও ছায়ার তলায় ও ঠাণ্ডা পরিবেশে নিয়ে যান।
- হাওয়া বাতাস দেওয়ার বন্দোবস্ত করুন, এসি বা পাখা চালিয়ে দিন। ।
- তাঁর জামাকাপড় যতটা সম্ভব খুলে বা ঢিলা করে দিন।
- শরীরের তাপমাত্রা কমাতে পানি বা ভেজা কাপড় দিয়ে অনবরত সারা শরীর মুছে দিন। বরফের ভেজানো ঠান্ডা পানি দিয়েও শরীর মোছা যাবে। ব্যক্তির বগলে ও কুঁচকির জায়গায় আইস প্যাক দিন।
- জ্ঞান থাকলে খাওয়ার স্যালাইন বা পানি খাওয়ান।
- শরীরের তাপমাত্রা বেশি বলে জ্বর ভেবে কোনো ওষুধ দেবেন না।
- রোগীকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত কাছের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক। যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা হয়, তত ভালো। দেরি করলে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
- হাসপাতাল খুব দূরে হলে রোগীর পাশে বরফের বড় বড় চাকা রেখে বাতাস দিতে থাকুন। রোগীকে কাত করুন। মুখে জমে থাকা লালা পরিষ্কার করুন।
- এইটুকু করতে পারলেই তাঁর প্রাণ বাঁচতে পারে। তাই তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া আরও কোনও পথ নেই।
প্রতিরোধে কিছু সতর্কতা–
সতর্কতামূলক কিছু পথ অবলম্বন করে নিজেই নিজেকে হিট স্ট্রোক থেকে রক্ষা করতে পারেন । যেমন-
- দিনের বেলায় যথাসম্ভব বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকুন । বিশেষ করে সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত ।
- রোদ এড়িয়ে চলুন, বাইরে বের হলে ছাতা, টুপি/ক্যাপ, বা কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখুন ।
- শিশুদের প্রচণ্ড রোদে বাইরে খেলাধুলা করতে দেবেন না। তাদের বাড়িতে ঠান্ডা জায়গায় রাখুন।
- বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তিদের দুপুরের দিকে বাইরে বেরতে দেবেন না। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তাদের ঘরেই থাকুন।
- দিনের বেলায় একটানা শারীরিক পরিশ্রম করা থেকে বিরত থাকুন
- রোদে অধিক সময় কাজ না করে মাঝে মাঝে ছায়ায় বিশ্রাম নিন।
- আগুনের কাছে কাজ করার সময় বিরতি নিয়ে ফ্যানের কাছে বসুন।
- হালকা রঙের, ঢিলে ঢালা এবং সম্ভব হলে সুতির জামা পরুন ।
- প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করুন, (খাওয়ার স্যালাইনও খেতে পারেন)।
- এসময় দিনে চা-কফি পান না করাই ভালো।
- সহযে হজম হয় এমন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন ।
- বাসি ও খোলা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন
- সম্ভব হলে একাধিকবার পানির ঝাপটা নিন বা গোসল করুন ।
- দূরপাল্লার যানবাহন ভ্রমনে হাতপাখা ও ঠান্ডা পানির বোতল সাথে রাখুন । মাঝে মাঝে একাধিকবার পানির ঝাপটা নিন ।
এই কয়েকটি নিয়ম মেনে চললেই সুস্থ থাকবেন।